Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

১নং আলীকদম ইউপি’র ইতিহাস

নামকরণ ও ঐতিহাসিক পটভূমিকাঃ

Name & Historical  Background.

আলীকদম নামকরণ নিয়ে বহুধা বিভক্ত মতামতের সন্ধান পাওয়া যায়। নামকরণ প্রসঙ্গে সম সাময়িক ইতিহাসে যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা থেকে বর্তমান নামকরণে বিসত্মর তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। এখানকার সমাজ-সংস্কৃতির পুরানো দলিল দস্তাবেজেও আলীকদম নামকরণ নিয়ে তথ্য পাওয়া যায়। তবে নামকরণ প্রসঙ্গে স্থানীয়ভাবে অনেক মতামত পাওয়া গেছে। নিন্মে তা বিধৃত করা হলঃ

‘আলোহক্যডং’ থেকে আলীকদম নামের উৎপত্তি। যার অর্থ পাহাড় ও নদীর মধ্যবর্তী স্থান। এ নামের সঙ্গে পার্বত্য এলাকার অনেক পাহাড়ের নামকরণের সাদৃশ্য আছে। যেমন: কেউক্রাডং, মেরাংডং, পেরাইডং, তাজিংডং প্রভৃতি। জানা গেছে, বোমাং সার্কেলের বোমাং চীপের নথিপত্রে ও ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আঁকা মানচিত্রে এই ‘আলোহক্যডং’ নামের সত্যতা পাওয়া যায়। জনৈক ব্রিটিশ সাহিত্যিক ক্যাপ্টেন টি, এইচ, লুইন এর মতে, Alley kingdom থেকে Alikadam হয়েছে। তিনি তাতে ব্যাখ্যা দেন যে, Alley অর্থ দমন Kingdom রাজ্য। কথিত আছে যে, মোগল আমলের সুবেদারই বাংলার সম্রাট শায়েস্তা খাঁ সাধারণ এবং ক্ষুদ্র একটি রাজ্য শক্তিকে (রাজনৈতিক সুরেশ্বরী রাজ্য কে) করায়ত্ব বা দমন করেন। তাই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে এ অঞ্চলের নাম হয় Alleykingdom বা দমন করা রাজ্য। 

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক আতিকুর রহমান তাঁর এক অনুসন্ধানী নিবন্ধে আলীকদম নিয়ে অনেক অজানা তথ্য হাজির করেছেন। তিনি তাঁর নিবন্ধে ‘আলীর পাহাড়’ নিয়ে কৌতিহলোদ্দীপক কতিপয় প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। আলীকদম উপজেলা সদর এলাকা থেকে পূর্ব দক্ষিণ দিকে তাকালে যে পাহাড়টি দেখা যায় সেটির নাম ‘আলীর পাহাড়’। এ নাম থেকে মুসলিম ঐতিহ্যমন্ডিত সভ্যতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রত্যন্ত এ দুর্গম অঞ্চলে কি করে আলীর পাহাড় নামকরণ হলো তা এক অর্থে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। কালের পরিক্রমায় এ নামটি অবিকৃত থাকলোই বা কি করে? আলীর পাহাড়ের সাথে সঙ্গতিশীল নাম হলো ‘আলীকদম’। যদিও মঘী উচ্চারণে এটির বিকৃত রূপ ‘আলোহক্যডং’ হয়েছে। আরকানী ভাষায় অনেক পাহাড় ও জায়গার নামে ডং, থং বা দং উপসর্গটি জুড়ে আছে বলে গবেষক আতিকুর রহমান তাঁর লিখিত গবেষণায় মত প্রকাশ করেছেন। সম্ভবত: ডং মানেই পাহাড়। তাই আলীর পাহাড়ই মঘী ভাষায় আলেহ ডং। তা থেকে আলেহ কেডং বা খেদং বিকৃতি।

পার্বত্য অঞ্চলের সর্বপ্রাচীন মানচিত্র (Ensea Det Bengalla); যা পর্তুগীজ পন্ডিত জোয়াও জে বারোজ (Jao De Barros) কর্তৃক ১৫৫০ সালে অঙ্কিত, তাতে এতদাঞ্চলকে ‘লোভাস ডোকাম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তা আলীকদম-’রই পর্তুগীজ ভাষ্য; আলেহক্যডং এর নয়। আলীকদম এর মঘী উচ্চারণ ‘আলেহ ক্যডং’ হয়ে যাওয়া সম্ভব। মঘী ভাষায় এর অর্থ করা কষ্ট কল্পনা মাত্র। আলীর পাহাড় আর আলীকদম উভয় নামই শব্দগত দিক দিয়ে মুসলিম ঐতিহ্য মন্ডিত।

আলীকদম নামকরণ নিয়ে কৌতুহলের অন্ত নেই। এ নামকরণ নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করাও বর্তমানে দুষ্কর। সম্ভবত: আলী নামের কেউ এই অঞ্চলে এক সময় আধিপত্য বিস্তার করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে আলী নামের সাথে ‘কদম’ শব্দটি যোগ হয়ে ‘আলীকদম’ হয়েছে। আরবীতে ‘কদম’ অর্থ পা, যাকে পদচারণাও বলা যায়। সুতরাং বলা যায়, আলী নামের কেউ সভ্যতার সূচনালগ্নে এখানে সর্বপ্রথম পদচারণা করেছিলেন।

আরকানী ইতিহাস সুত্রে জানা যায়, ১৮ জন আরকানী রাজা শাসন কার্যের সুবিধার্থে মুসলিম উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে ১৪৩৪-১৪৫৯ খ্রীষ্টাব্দে শাসন কার্য পরিচালনাকারী রাজা মাং খারি’র মুসলিম উপধি ছিল ‘‘আলী খান’’ এবং ১৫৩১ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ রাজত্ব পরিচালনাকারী রাজা থাজাথা’র মুসলিম উপাধি ছিল আলী শাহ্। এ থেকে বলা যেতে পারে এ রাজাদ্বয়ের আলাদা কোন প্রভাব এ এলাকায় পড়েছিল। যার প্রেক্ষিতে ‘‘আলীকদম’’ নামের সৃষ্টি হতে পারে।

মতান্তর রয়েছে যে, ৩৬০ আওলিয়া উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন। এঁদের একটি সংখ্যা হয়ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলামের জয় নিশান উড়িয়েছিলেন। এঁদেরই মধ্যে হয়ত ‘আলী’’ নামের কোন সাধক পার্বত্য এতদাঞ্চল আসেন। যার পদধুলিতে ধন্য হয়ে এ এলাকার নাম ‘‘আলীকদম’’ হয়েছে। 

জনশ্রুতি আছে, ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (র.) রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করেছেন। তাঁর এতাদাঞ্চল সফর করার ফলশ্রুতিতে ‘আলীকদম’ নামকরণ হতে পারে। তবে এ দাবী ইসলামের ইতিহাস মতে সমর্থন যোগ্য নয়। কারণ ইসলামের সূচনা পর্বে হযরত মুহাম্মদ (স.) ’র একজন মাত্র সাহাবীই উপমাহাদেশে এসেছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস নামের একজন সাহাবী চীন হয়ে চট্টগ্রাম আসেন আবার চীনেই তিনি চলে যান বলে বর্ণিত আছে। তাঁর সমাধিও চীনে রয়েছে বলে জানা যায়। সুতরাং পূর্বোক্ত জনশ্রুতির সত্যতাকে মেনে নেয়া যায় না। তবে আলীকদম নামটি নানা রূপকথা ও অর্ধসত্য কাহিনীতে ভরপুর। এর সত্যতা উদ্ধারের প্রচেষ্টাও ক্ষীণ। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আসল তথ্য হয়ত কোনদিনই জানতে পারবে না।

ইতিহাস-ঐতিহ্যঃ

History-Tradition

    ................. মাতামুহুরী উপত্যকাভূক্ত আলীকদম থেকে পার্শ্ববর্তী আরকান/বার্মার সীমান্ত অঞ্চল বেশী দুরে নয়। সমসাময়িক ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, আলীকদম একটি প্রাচীন জনপদ। ১৭১১ খ্রীস্টাব্দে জনৈক চন্দন খাঁ ওরফে তৈন খাঁ মাতামুহুরী সীমান্তে একটি উপজাতীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন আরকানী রাজার অনুগত সামন্ত। তার চতুর্থ পুরুষ জালাল খাঁ মোগলদের আনুগত্য স্বীকার করেন এবং খাজনা দিতে সম্মত হোন। কিন্তু ১৭২৪ খ্রীস্টাব্দে তিনি মোগল সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তখন দোহাজারী ঘাটির মোগল ফৌজদার কৃষাণ চাঁদ তার বিরুদ্ধে অভিযান করেন। ফলে বিদ্রোহীরা পরাজিত, পর্যুদুস্ত ও আরাকানে বিতাড়িত হন। 

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক সাংবাদিক আতিকুর রহমান তাঁর এক গবেষণায় লিখেছেন ........এতদাঞ্চল প্রাচীন মুসলিম অধিকৃত এলাকা। বিস্মিত হলেও এখানকার প্রাচীন মুসলিম আধিপত্য অল্প বিস্তর ইতিহাসে বিবৃত আছে। ইতিহাসে দেখা যায় আরকানের রাজা ইঙ্গ চন্দ্র ৯৫৩ ইং সালে জৈনক ‘সুরতান’ কে তাড়া করে চট্টগ্রামের দিকে অভিযান করেছেন এবং এ অভিযানে কুমিরার কাওনিয়াছড়া পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চল তার দখলীভুত হয়। ‘সুরতান’ আরবী সুলতান শব্দেরই মঘী বিকৃতি। যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো রাজা।

এটাই প্রামাণ: বাংলায় মুসলিম সুলতানী আমল শুরু হওয়ার প্রায় ৩ শত বছর আগে দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুসলিম রাজত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটে গিয়েছিলো। ১৩৩৯-৪০ ইং সালে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ্ প্রথম এ অঞ্চল বাংলা সুলতানাতের অন্তর্ভূক্ত করেন। ১৪০৬ খ্রী: সালে আরকানের রাজা নরমিখলা বর্মী রাজা কর্তৃক রাজ্যচ্যুত হন। পরে তিনি সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ২৪ বছর পর ১৪৩২ ইং সালে সুলতান জামাল উদ্দিনের সহায়তায় তিনি স্বরাজ্য পূণর্দখল করেন। সে অভিযান কালে দক্ষিণ চট্টগ্রামে কোন বিজাতীয় শাসন থাকলে নির্বিবাদে তা ডিঙ্গিয়ে আরকান দখল করা সম্ভব হতো না। রাজা নরমিখলার রাজ্য প্রতিরক্ষায় সুলতানের সৈন্যরা তথায় ঘাটি স্থাপন করেন। রাজ্য পরিচালনায় তখন মুসলিম আমলাদের নিযুক্ত করা হয়। ওদের সঙ্গী সাথী হয়ে আরকানের সাধারণ বাঙ্গালীরাও ভাগ্যান্বেষণে বিপুল সংখ্যায় যায়। এ প্রভাবে গোটা দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী শঙ্খ, মাতামুহুরী ও নাফ নদী হয়ে পড়ে বাঙ্গালী মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। পরে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ১৫১২ সালে গোটা চট্টগ্রাম নিজ দখলে আনেন। খোদা বখশ্ খান ছিলেন তার অধীনে দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের শাসক। এ প্রশাসনিক এলাকার সদর দফতর ছিলো আলীকদম। মিঃ বারোজের মানচিত্রে এ আলীকদম রাজ্য ও খোদা বখশ্ খানের কথা পরিস্কার ভাবে ব্যক্ত আছে।

তদানিন্দন কালের কাহিনী ও ইতিহাসসুত্রে একথা বলা যায় যে, পার্বত্য আলীকদম উপজেলা পার্বত্যাঞ্চলের ইতিহাসের উপজীব্য। এখানকার বিলুপ্তপ্রায় আলীর সুড়ঙ্গ ছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন পুকুর। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী ২নং চৈক্ষ্যং ইউনিয়নস্থ ৩নং ওয়ার্ডের নয়াপাড়া গ্রামে প্রাচীন ইটভাটার অস্থিত্ব এখনো বিদ্যমান। যা বর্তমানে নয়াপাড়া সরকারী প্রাঃ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্বে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বসতভিটা। গত ২৪ অক্টোবর/১৯৯৯ ইং সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গ্রন্থপ্রণেতা গবেষক আতিকুর রহমান সহ স্থানীয় সাংবাদিকরা ঐ এলাকায় মাটি খুঁড়ে ইট আবিস্কার করেছেন। আবিস্কৃত ইটগুলোর গঠনপ্রণালীতে সুলতানী আমলের ইট বলে অনুমিত হয়। উদ্ধারকৃত ইটিগুলো লম্বায় সাত ইঞ্চি প্রস্থে সাড়ে চার ইঞ্চি আর পুরো দেড় ইঞ্চি মাত্র। প্রস্থের দ্বিগুণ লম্বা হলে ৯ ইঞ্চি হওয়ার কথা। সম্ভবত ক্ষয় হয়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। আবিস্কৃতি ইটগুলো বর্তমানে আলীকদম প্রেসক্লাবে রক্ষিত আছে। 

তথ্য সূত্রঃ  স্থানীয় সাংবাদিক জনাব মমতাজ উদ্দিন আহমদ লিখিত ও আলীকদম প্রেসক্লাব সম্পাদিত- প্রেক্ষণ: পার্বত্য চট্টগ্রাম গিরিনন্দিনী আলীকদম হইতে উদৃত।